ইসলাম

শাবান মাসের ফজিলত, কুরআনের আয়াত, হাদিস, রোজা ও দোয়া

শাবান মাস সম্পর্কে কোরআনের আয়াত | শাবান মাস সম্পর্কে হাদিসসমূহ | শবে বরাত ও শাবান মাসের রোজা

শাবান মাস হিজরি বছরের অষ্টম মাস এবং এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। এটি রমজানের প্রস্তুতির মাস এবং এতে শবে বরাতসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তাই শাবান মাসের ফজিলত, কুরআনের আয়াত, হাদিস, রোজা ও দোয়া সম্পর্কিত নিবন্ধন ভাল ভাবে পড়ুন। যার মাধ্যমে শাবান মাসের ফজিলত কুরআনের আয়াত হাদিস রোজা ও দোয়ার তথ্য গুলো জানুন।

Shaban মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত, করণীয় ও বর্জনীয়

শাবান মাস সম্পর্কে কোরআনের আয়াত

অনেকেই জানতে চান, শাবান মাস সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো কোরআনের আয়াত আছে কি না? যদিও কোরআনে সরাসরি “শাবান” শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি, তবে এর গুরুত্ব বোঝাতে কিছু আয়াত ব্যাখ্যা করা হয়।

১. সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪):

“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে এই কোরআন অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী। এ রাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।”

এই আয়াতকে অনেকে শাবান মাসের ১৫ তারিখের (শবে বরাতের) সঙ্গে সংযুক্ত করে থাকেন। যদিও ইসলামী ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে, তবে কিছু হাদিসে শবে বরাতের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

২. সুরা আল-কদর (৯৭:১-৫):

“নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো কদরের রাত কী? কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এতে ফেরেশতাগণ এবং রুহ (জিব্রাইল) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক বিষয়ে অবতীর্ণ হন। এটি শান্তি ও নিরাপত্তার রাত, যা ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।”

যদিও এটি শবে কদর সম্পর্কে, তবে অনেক ইসলামিক স্কলার বলেন, শবে বরাতের রাতও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত যা শাবান মাসের ১৫ তারিখে পালিত হয়। কিছু বর্ণনায় বলা হয়, এই রাতে মানুষের তাকদির লেখা হয় এবং ক্ষমা লাভের জন্য বিশেষ ইবাদত করা হয়।

শাবান মাস সম্পর্কে হাদিসসমূহ

১. শাবান মাসে অধিক রোজার ফজিলত:

আয়েশা (রা.) বলেন:

“আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শাবান মাসের চেয়ে বেশি কোনো মাসে রোজা রাখতে দেখিনি।” (বুখারি, মুসলিম)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা সুন্নত।

২. শাবান মাসে আমল পেশ করা হয়:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“শাবান মাস হলো এমন এক মাস, যাতে বান্দাদের আমল আল্লাহর দরবারে তোলা হয়। আমি চাই যে, আমার আমল যখন উপস্থাপিত হয়, তখন আমি রোজাদার থাকি।” (নাসাঈ, হাদিস: ২৩৫৭)

এতে বোঝা যায় যে, এ মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার ফজিলত রয়েছে।

৩. শাবান মাসের মধ্যরাত (শবে বরাত) সম্পর্কে হাদিস:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“যখন শাবানের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহ পৃথিবীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮০)

তাই, শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়।

৪. শাবান মাসে অধিক দোয়া ও ইস্তিগফার করা:

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“শাবান হলো আমার মাস, আর রমজান হলো আমার উম্মতের মাস।” (দাইফ হাদিস)

যদিও এই হাদিসটি দুর্বল, তবে অনেক ইসলামিক পণ্ডিত এই মাসকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

শাবান মাসের বিশেষ দোয়া

শাবান মাসে কিছু নির্দিষ্ট দোয়া রয়েছে, যা রাসুল (সা.) এবং সাহাবারা বেশি বেশি পড়তেন। এসব দোয়া বান্দার গুনাহ মাফ, রিজিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

১. শাবান মাসে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া

اللهم اغفر لي وارحمني واهدني وعافني وارزقني

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফিরলি ওয়ারহামনি ওয়াহদিনি ওয়া’আফিনি ওয়ারযুকনি।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে সঠিক পথ দেখান, আমাকে সুস্থতা দান করুন এবং আমাকে রিজিক দিন।

এই দোয়া বেশি বেশি পড়া সুন্নত, কারণ শাবান মাস হলো গুনাহ মোচনের মাস।

২. রমজানের প্রস্তুতির জন্য দোয়া

اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রমাদান।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।

এই দোয়া রাসুল (সা.) রজব ও শাবান মাসে বেশি পড়তেন।

৩. রিজিক বৃদ্ধির জন্য দোয়া

اللهم اكفني بحلالك عن حرامك وأغنني بفضلك عمن سواك

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়াগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক।

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার হালাল দিয়ে হারাম থেকে বাঁচাও এবং তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত কর।

এই দোয়া অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য খুবই কার্যকর।

শাবান মাসে করণীয় আমল

শাবান মাসে দোয়া ছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যা আমাদের জন্য কল্যাণকর।

১. নফল রোজা রাখা

আয়েশা (রা.) বলেন: “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শাবান মাসের চেয়ে বেশি কোনো মাসে রোজা রাখতে দেখিনি।” (বুখারি, মুসলিম)

শাবান মাসে রোজা রাখা সুন্নত, বিশেষত প্রথম ১৫ দিন।

২. কুরআন তিলাওয়াত বৃদ্ধি করা

রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।

৩. ইস্তিগফার ও দোয়া করা

শাবান মাস হলো গুনাহ মাফের মাস, তাই এই মাসে “আস্তাগফিরুল্লাহ” বেশি বেশি বলা উচিত।

৪. গরিব-দুঃখীদের দান করা

রাসুল (সা.) বলেছেন: “দান-সাদাকা গুনাহকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুন নিভিয়ে ফেলে।” (তিরমিজি)

এই মাসে দান-সাদাকা করলে আল্লাহর রহমত লাভ হয়।

শবে বরাত ও শাবান মাসের রোজা

শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে “শবে বরাত” বলা হয়, যা ইসলামী ঐতিহ্যে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। অনেকে এ রাতে ইবাদত করেন এবং পরদিন রোজা রাখেন। হাদিসে এসেছে:

“যখন শাবানের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহ পৃথিবীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮০)

এই রাতের পরদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।


শাবান মাসে রোজা সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা

১. শাবান মাসে পুরো মাস রোজা রাখা ফরজ নয়: অনেকেই মনে করেন যে, পুরো শাবান মাস রোজা রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাসুল (সা.) নিজে পুরো মাস রোজা রাখতেন না, তাই এটি ফরজ নয়।

২. শবে বরাতের রোজা রাখা আবশ্যক নয়: শবে বরাতের রোজা রাখা মুস্তাহাব, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।

৩. শাবানের শেষের রোজা সম্পর্কে সতর্কতা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“তোমরা রমজানের এক-দুই দিন আগে রোজা রেখো না, যদি না কেউ নিয়মিত রোজা রাখার অভ্যাসে থাকে।” (বুখারি, মুসলিম)

অর্থাৎ, ২৮ ও ২৯ শাবানে নফল রোজা রাখা নিষেধ, যেন তা রমজানের ফরজ রোজার সঙ্গে মিশে না যায়।

শাবান মাসে করণীয়

১. নফল রোজা: ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা রাখা মুস্তাহাব। ২. ইবাদত বৃদ্ধি: কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ, ইস্তিগফার করা। ৩. শবে বরাতের রাত জাগরণ: নামাজ, কুরআন পাঠ ও দোয়া করা। ৪. গরীব ও দুস্থদের দান: এ মাসে দান-সদকা করা উচিত। ৫. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা: বিদ্বেষ, হিংসা ও শিরক থেকে বাঁচা।

উপসংহার

শাবান মাস একটি ফজিলতপূর্ণ মাস, যা রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে গণ্য হয়। এ মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা, ইবাদত করা, এবং শবে বরাত রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। শাবান মাসের ফজিলত, কুরআনের আয়াত, হাদিস, রোজা ও দোয়া আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ মাসের বরকত ও রহমত অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *